নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ
আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের 'পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান! না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ। জাগিয়া উঠেছে প্রাণ, ওরে উথলি উঠেছে বারি, ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি। থর থর করি কাঁপিছে ভূধর, শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে, ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল গরজি উঠিছে দারুণ রোষে। হেথায় হোথায় পাগলের প্রায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায়-- বাহিরিতে চায়, দেখিতে না পায় কোথায় কারার দ্বার। কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন, চারি দিকে তার বাঁধন কেন! ভাঙ্ রে হৃদয়, ভাঙ্ রে বাঁধন, সাধ্ রে আজিকে প্রাণের সাধন, লহরীর 'পরে লহরী তুলিয়া আঘাতের 'পরে আঘাত কর্। মাতিয়া যখন উঠেছে পরান কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ! উথলি যখন উঠেছে বাসনা জগতে তখন কিসের ডর! আমি ঢালিব করুণাধারা, আমি ভাঙিব পাষাণকারা, আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া আকুল পাগল-পারা। কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া, রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া, রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া দিব রে পরাণ ঢালি। শিখর হইতে শিখরে ছুটিব, ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব, হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি। এত কথা আছে, এত গান আছে, এত প্রাণ আছে মোর, এত সুখ আছে, এত সাধ আছে-- প্রাণ হয়ে আছে ভোর।। কী জানি কী হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ-- দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান। ওরে, চারিদেকে মোর এ কী কারাগার ঘোর-- ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাত কর্। ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি, এসেছে রবির কর।।
দুই বিঘা জমি
শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে। বাবু বলিলেন, ``বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে। কহিলাম আমি, ``তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই। চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো-জোর মরিবার মতো ঠাঁই। শুনি রাজা কহে, ``বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা, পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দীঘে সমান হইবে টানা--- ওটা দিতে হবে। কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি সজলচক্ষে, ``করুণ রক্ষে গরিবের ভিটেখানি! সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া! দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া! আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে; কহিলেন শেষে ক্রূর হাসি হেসে, ``আচ্ছা, সে দেখা যাবে।
পরে মাস-দেড়ে ভিটেমাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে--- করিল ডিক্রি সকলি বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে। এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি! রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি। মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে, তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে। সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য--- কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য! ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি, তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি। হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো, একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল। নমোনমো নমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি--- গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি। অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি--- ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি। পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ--- স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল, নিশীথশীতল স্নেহ। বুকভরা মধু, বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে--- ``মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে। দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে, কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি রথতলা করি বামে--- রাখি হাটখোলা, নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে। ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে, নিলাজ কুলটা ভূমি, যখনি যাহার তখনি তাহার--- এই কি জননী তুমি! সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা! আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ--- পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ! আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন, তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন! ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন--- কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোনো চিহ্ন! কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ি, ক্ষুধাহরা সুধারাশি। যত হাসো আজ যত করো সাজ ছিলে দেবী--- হলে দাসী। বিদীর্ণ-হিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি; প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে, সেই আমগাছ, একি! বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা, একে একে মনে উদিল স্মরণে বালক-কালের কথা। সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিক ঘুম--- অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম; সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন--- ভাবিলাম, হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন! সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে; দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে। ভাবিলাম মনে বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা--- স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা! হেনকালে হায় যমদূত-প্রায় কোথা হতে এল মালী, ঝুঁটি-বাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি! কহিলাম তবে, ``আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব--- দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব! চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ; বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ। শুনি বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, ``মারিয়া করিব খুন! বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ। আমি কহিলাম, ``শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়! বাবু কহে হেসে, ``বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়। আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে! তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!
১৪০০ সাল
আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতুহলভরে, আজি হতে শতবর্ষ পরে! আজি নব বসন্তের প্রভাতের আনন্দের লেশমাত্র ভাগ, আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান, আজিকার কোনো রক্তরাগ- অনুরাগে সিক্ত করি পারিব কি পাঠাইতে তোমাদের করে, আজি হতে শতবর্ষ পরে? তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার বসি বাতায়নে সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি ভেবে দেখো মনে- একদিন শতবর্ষ আগে চঞ্চল পুলকরাশি কোন্ স্বর্গ হতে ভাসি নিখিলের মর্মে আসি লাগে, নবীন ফাল্গুনদিন সকল-বন্ধন-হীন উন্মত্ত অধীর, উড়ায়ে চঞ্চল পাখা পুষ্পরেণুগন্ধমাখা দক্ষিণসমীর সহসা আসিয়া ত্বরা রাঙায়ে দেয়েছে ধরা যৌবনের রাগে, তোমাদের শতবর্ষ আগে। সেদিন উতলা প্রাণে, হৃদয় মগন গানে, কবি একা জাগে- কত কথা পুষ্প প্রায় বিকশি তুলিতে চায় কত অনুরাগে, একদিন শতবর্ষ আগে। আজি হতে শতবর্ষ পরে এখন করিছে গান সে কোন্ নুতন কবি তোমাদের ঘরে! আজিকার বসন্তের আনন্দ-অভিবাদন পাঠায়ে দিলাম তাঁর করে। আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে- হৃদয়স্পন্দনে তব, ভ্রমরগুঞ্জনে নব, পল্লবমর্মরে, আজি হতে শতবর্ষ পরে।।
এক গাঁয়ে
আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি, সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ। তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি তাহার গানে আমার নাচে বুক। তাহার দুটি পালন-করা ভেড়া চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে, যদি ভাঙে আমার ক্ষেতের বেড়া কোলের 'পরে নিই তাহারে তুলে। আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা, আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা, আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে, আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ॥ দুইটি পাড়ায় বড়োই কাছাকাছি, মাঝে শুধু একটি মাঠের ফাঁক। তাদের বনের অনেক মধুমাছি মোদের বনে বাঁধে মধুর চাক। তাদের ঘাটে পূজার জবামালা ভেসে আসে মোদের বাঁধা ঘাটে, তাদের পাড়ার কুসুম-ফুলের ডালা বেচতে আসে মোদের পাড়ার হাটে। আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা, আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা, আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে, আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ॥ আমাদের এই গ্রামের গলি-'পরে আমের বোলে ভরে আমের বন। তাদের ক্ষেতে যখন তিসি ধরে মোদের ক্ষেতে তখন ফোটে শণ। তাদের ছাদে যখন ওঠে তারা আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছোটে। তাদের বনে ঝরে শ্রাবণ-ধারা, আমার বনে কদম ফুটে ওঠে। আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা, আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা, আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে, আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ॥
|