Language Selection
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - ব্যঙ্গকৌতুক: বিনি পয়সার ভোজ

বিনি পয়সার ভোজ

আপিসের বেশে অক্ষয়বাবু (হাসিতে হাসিতে) আজ আচ্ছা জব্দ করেছি। বাবু রোজ আমাদের স্কন্ধে বিনামূল্যে বিনামাশুলে ইয়ার্কি দিয়ে বেড়ান, আর লম্বাচওড়া কথা কন। মশায়, আজ বছর-খানেক ধরে রোজ বলে ‘ আজ খাওয়াব'‘ কাল খাওয়াব', খাওয়াবার নাম নেই। যতখানি আশা দিয়েছে তার সিকি পরিমাণ যদি আহার দিত তা হলে এতদিনে তিনটে রাজসূয় যজ্ঞ হতে পারত। যা হোক, আজ তো বহু কষ্টে একটা নিমন্ত্রণ আদায় করা গেছে। কিন্তু, দুটি ঘণ্টা বসে আছি এখনো তার দেখা নেই। ফাঁকি দিলে না তো?

(নেপথ্যে চাহিয়া) ওরে, কী তোর নাম, ভূতো না মোধো, না হরে?

চন্দ্রকান্ত? আচ্ছা, বাপু, তাই সই। তা, ভালো চন্দ্রকান্ত, তোমার বাবু কখন আসবে বলো দেখি।

কি বললি? বাবু হোটেল থেকে খাবার কিনে আনতে গেছেন? বলিস কী রে! আজ তবে তো রীতিমত খানা! খিদেটিও দিব্যি জমে এসেছে। মটন-চপের হাড়গুলি একেবারে পালিশ করে হাতির দাঁতের চুষিকাঠির মতো চক্‌চকে করে রেখে দেব। একটা মুর্গির কারি অবিশ্যি থাকবে— কিন্তু, কতক্ষণই বা থাকবে! আর দু-রকমের দুটো পুডিং যদি দেয় তা হলে চেঁচেপুঁচে চীনের বাসনগুলোকে একেবারে কাঁচের আয়না বানিয়ে দেব। যদি মনে ক'রে ডজন-দুত্তিন অয়্‌স্টার প্যাটি আনে তা হলে ভোজনটি বেশ পরিপাটি রকমের হয়। আজ সকাল থেকে ডান চোখ নাচছে, বোধ হয় অয়্‌স্টার প্যাটি আসবে।

ওহে ও চন্দ্রকান্ত, তোমার বাবু কখন গেছেন বলো দেখি।

অনেকক্ষণ গেছেন? তবে আর বিস্তর বিলম্ব নেই। ততক্ষণ এক ছিলিম তামাক দাও-না। অনেকক্ষণ ধরে বলছি, কিন্তু তোমার কোনো গা দেখছি নে।

তামাক বাইরে নেই? বাবু বন্ধ করে রেখে গেছেন? এমন তো কখনো শুনি নি। এ তো কোম্পানির কাগজ নয়। কী করা যায়! আমি একটু-আধটু আফিম খাই, তামাক না হলে আর তো বাঁচি নে। ওহে মোধো, না, না, চন্দ্রকান্ত, কোনোমতে মালীদের কাছ থেকে হোক, যেখান থেকে হোক, এক ছিলিম জোগাড় করে দিতে পার-না?

বাজার থেকে কিনে আনতে হবে? পয়সা চাই? আচ্ছা বাপু, তাই সই। এই নাও, এক পয়সার তামাক চট করে কিনে নিয়ে এসো।

এক পয়সার তামাক হবে না? কেন হবে না! বাপু, আমাকে কি মুচিখোলার নবাব বলে হঠাৎ তোমার ভ্রম হয়েছে? ষোলো টাকা ভরি অম্বুরি তামাক না হলেও আমার কষ্টেসৃষ্টে চলে যায়— এক পয়সাতেই ঢের হবে।

হুঁকো-কলকেও কিনে আনতে হবে? সেও তোমার বাবু লোহার সিন্দুকে পুরে রেখে গেছেন নাকি? বাঙাল ব্যাঙ্কে সেফ ডিপজিট করে আসেন নি কেন! ওরে বাস রে! এ তো ভালো জায়গায় এসে পড়া গেছে দেখছি। তা নাও, এই ছটি পয়সা ট্র্যামের জন্যে রেখেছিলুম। উদয় ফিরে এলে তার কাছ থেকে সুদ-সুদ্ধ আদায় করে নিতে হবে।— এই বুঝি বাবুর বাগানবাড়ি, তা হলে এঁর ভদ্রাসন-বাড়ি কিরকম হবে না জানি! কড়িগুলো মাথায় ভেঙে না পড়লে বাঁচি। এই তো একখানি ভাঙা চৌকি আসবাবের মধ্যে। এ আমার ভর সইবে না। সেই অবধি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে পা ব্যথা হয়ে গেল— আর তো পারি নে— এই মাটিতেই বসা যাক।

কোঁচা দিয়া ধুলা ঝাড়িয়া একটা খবরের কাগজ মাটিতে পাতিয়া উপবেশন ও গুন্‌গুন্‌ স্বরে গান

যদি জোটে রোজ
এমনি বিনি পয়সায় ভোজ!
ডিশের পরে ডিশ
শুধু মটন কারি ফিশ,
সঙ্গে তারি হুইস্কি সোডা দু-চার রয়াল ডোজ!
পরের তহবিল
চোকায় উইল্‌সনের বিল—
থাকি মনের সুখে হাস্যমুখে কে কার রাখে খোঁজ!

কই রে? তামাক এল? ও কী রে? শুধু কলকে? হুকোঁ কই? এখানে ছ পয়সায় হুঁকো পাওয়া যায় না? কলকেটার দাম দু আনা? হ্যা দেখো বাপু চন্দ্রকান্ত, বাইরে থেকে আমাকে দেখে যতটা বোকা মনে হয় আমি ততটা নই। শরীরটা যত মোটা, বুদ্ধিটা তার চেয়ে কিঞ্চিৎ সূক্ষ্ম। তোমার বাবু যে হুঁকোটা কলকেটা তামাকটা পর্যন্ত আয়্‌রন্‌চেস্টে তুলে রেখে দেন, এতক্ষণে তার কারণ বোঝা গেল। কেবল তোমার মতো রত্নটিকে বাইরে রাখাই তাঁর ভুল হয়েছে। বোধ হয় বেশি দিন বাইরে থাকতেও হবে না। কোম্পানি-বাহাদুর একবার খবরটি পেলেই পাহারা বসিয়ে খুব হেপাজতের সঙ্গেই তোমাকে রাখবেন। যা হোক, তামাক না খেয়ে তো আর বাঁচি নে। ( কলিকায় মুখ দিয়া তামাক টানিয়া কাশিতে কাশিতে) ওরে বাবা, এ কোথাকার তামাক! এ যে উইল করে টানতে হয়। এর দু টান টানলে স্বয়ং বাবা ভোলানাথের মাথার চাঁদি ফট্‌ করে ফেটে যায়, নন্দীভৃঙ্গীর ভিরমি লাগে। কাজ নেই বাপু, থাক্‌। বাবু আগে আসুন। কিন্তু, বাবুর আসবার জন্যে তো কোনোরকম তাড়া দেখছি নে। সে বোধ হয় প্যাটিগুলো একটি একটি করে শেষ করছে। এ দিকে আমার পেট এমনই জ্বলে উঠেছে যে, মনে হচ্ছে যেন এখনি কোঁচায় আগুন ধরে যাবে। তৃষ্ণাও পেয়েছে। কিন্তু, জল চাইলেই আমাদের চন্দ্রকান্ত বলে বসবেন গেলাস কিনে আনতে হবে, বাবু বন্ধ করে রেখে গেছেন। কাজ নেই, বাগানের ডাব খাওয়া যাক। ওহে বাপু চন্দ্র, একটি কাজ করতে পার? বাগান থেকে চট করে একটি ডাব পেড়ে আনতে পার? বড়ো তেষ্টা পেয়েছে।

কেন? ডাব পাওয়া যাবে না কেন? বাগানে তো ডাব বিস্তর দেখে এলুম।

সব গাছ জমা দেওয়া হয়েছে? তা, হোক-না বাপু, একটি ডাবও মিলবে না?

পয়সা চাই? পয়সা তো আর নেই। তবে থাক্‌, বাবু আসুন, তার পরে দেখা যাবে।— সঙ্গে মাইনের টাকা আছে, কিন্তু ওকে ভাঙাতে দিতে সাহস হয় না। এখনো কোম্পানির মুল্লুকে যে এতবড়ো একটি ডাকাত বাইরে ছাড়া আছে তা আমি জানতুম না— যাই হোক, এখন উদয় এলে যে বাঁচি।

ঐ বুঝি আসছে। পায়ের শব্দ শুনছি। আঃ, বাঁচা গেল। ওহে উদয়, ওহে উদয়! কই, না তো। তুমি কে হে?

বাবু তোমাকে পাঠিয়ে দিলেন? তার চেয়ে নিজে এলেই তো ভালো করতেন। খিদেয় যে মারা গেলুম।

হোটেলের বাবু? কেরানিবাবু? কই, তাঁর সঙ্গে আমার তো কোনো আত্মীয়তা নেই। কিছু খাবার পাঠিয়েছেন বলতে পার?

অয়্‌স্টার প্যাটি?

পাঠান নি? বিল পাঠিয়েছেন? কৃতার্থ করেছেন আর-কি। যে বাবুটির নামে বিল তিনি এখানে উপস্থিত নেই।

আরে, না রে না। আমি না। এও তো ভালো বিপদে পড়লুম।— আরে, মাইরি না। কী গেরো! তোমাকে ঠকিয়ে আমার লাভ কী বাপু? আমি নিমন্ত্রণ খেতে এসে তিন ঘণ্টা এখানে বসে আছি— তুমি হোটেল থেকে আসছ, তবু তোমাকে দেখেও অনেকটা তৃপ্তি হচ্ছে। বোধ হয় তোমার ঐ চাদরখানা সিদ্ধ করলে ওর থেকে নিদেন— ভয় নেই, আমি তোমার চাদর নেব না, কিন্তু বিলটিও চাই নে।

এ তো ভালো মুশকিল দেখছি। ওগো, না গো না। আমি উদয়বাবু নই, আমি অক্ষয়বাবু। কী গেরো! আমার নাম আমি জানি নে, তুমি জান! অত গোলে কাজ কী বাপু, তুমি নীচে গিয়ে একটু বোসো, উদয়বাবু এখনই আসবেন।

বিধাতা সকালবেলায় এইজন্যেই কি ডান চোখ নাচিয়েছিলে? হোটেল থেকে ডিনার না এসে বিল এসে উপস্থিত!—

সখি, কী মোর করম ভেল!

পিয়াসা লাগিয়া জলদ সেবিনু, বজর পড়িয়া গেল!

হে বিধি, তোমারই বিচারে সমুদ্রমন্থনে একজন পেলে সুধা, আর-একজন পেলে বিষ। হোটেল-মন্থনেও কি একজন পাবে মজা, আর-একজন পাবে তার বিল! বিলটাও তো কম দিনের নয় দেখছি।

তুমি আবার কে হে? বাবু পাঠিয়ে দিলে? বাবুর যথেষ্ট অনুগ্রহ। কিন্তু, তিনি কি মনে করেছেন তোমার মুখখানি দেখেই আমার ক্ষুধাতৃষ্ণা দূর হবে? তোমার বাবু তো বড়ো ভদ্রলোক দেখছি হে।

কী বললে? কাপড়ের দাম? কার কাপড়ের দাম?

উদয়বাবু কাপড় কিনবেন আর অক্ষয়বাবু তার দাম দেবে? তোমার তো বিবেচনাশক্তি বেশ দেখছি।

সত্যি নাকি? কিসে ঠাওরালে আমারই নাম উদয়বাবু? কপালে কি সাইন্‌বোর্ড্‌ টাঙিয়ে রেখেছি? আমার অক্ষয়বাবু নামটা কি তোমার পছন্দ হল না?

নাম বদলেছি? আচ্ছা বাপু, শরীরটি তো বদলানো সহজ ব্যাপার নয়। উদয়বাবুর সঙ্গে কোন্‌খানটা মেলে, বলো দেখি।

উদয়বাবুকে কখনো চাক্ষুষ দেখ নি? আচ্ছা, একটু সবুর করো, তোমার মনের আক্ষেপ মিটিয়ে দেব। বিস্তর দেরি হবে না, তিনি এলেন ব'লে।

আরে ম'ল! আবার কে আসে? মশায়ের কোত্থেকে আসা হল? মশায়েরও এখানে নিমন্ত্রণ আছে বুঝি?

বাড়িভাড়া? কোন্‌ বাড়ির ভাড়া মশায়? এই বাড়ির? ভাড়াটা কত হিসাবে?

মাসে সতেরো টাকা? তা হলে হিসেব করুন দেখি সাড়ে তিন ঘণ্টায় কত ভাড়া হয়।

ঠাট্টা করছি নে মশায়, মনের সেরকম প্রফুল্ল অবস্থা নয়। এ বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে আমি সাড়ে তিন ঘণ্টা কাল আছি। সেজন্যেও যদি ভাড়া দিতে হয় তো ন্যায্য হিসেব করে নিন। তামাকটা পর্যন্ত পয়সা দিয়ে খেয়েছি।

আজ্ঞে না, আপনি ঠিকটি অনুমান করতে পারেন নি— আপনার ঈষৎ ভুল হয়েছে— আমার নাম উদয় নয়, অক্ষয়। এরকম সামান্য ভুলে অন্য সময় বড়ো একটা কিছু আসে যায় না, কিন্তু বাড়িভাড়া-আদায়ের সময় বাপ-মায়ে যার যে নাম দিয়েছেন সেইটে বাঁচিয়ে কাজ করলেই সুবিধে হয়।

আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলছেন? মাপ করবেন, ঐটি পারব না। সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে পেটের জ্বালায় মরছি, ঠিক যেই খাবারটি আসবার সময় হল অমনি আপনি গাল দিচ্ছেন বলেই যে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব আমাকে তেমন গর্দভ ঠাওরাবেন না।

আপনি ঐখানেই বসুন, যা যা বলবার অভিপ্রায় আছে বলে যান, আমি আহারান্তে বাড়ি ছেড়ে যাব। বকে বকে আমার গলা শুকিয়ে এল, আর তো বাঁচি নে। খিদেয় নাড়িগুলো বেবাক হজম হয়ে গেল। ঐ-যে পায়ের শব্দ! ওহে উদয়, আমার অন্ধের নড়ি, আমার সাগর-সেঁচা সাত রাজার ধন মানিক, একবার উদয় হও হে! আর তো প্রাণ বাঁচে না।

তুমি আবার কে হে? যদি গালমন্দ দেবার থাকে তো ঐখানে বসে আরম্ভ করে দাও। দোহার্কি করবার অনেকগুলি লোক উপস্থিত আছেন।

হরিবাবু আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন? শুনে বড়ো সন্তোষ লাভ করলুম। তিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার পরম বন্ধু যাঁরা আমাকে নিমন্ত্রণ করে পাঠিয়েছেন তাঁদের কোনো দেখাসাক্ষাৎ নেই আর যাঁদের সঙ্গে আমার কোনো কালে পরিচয় নেই তাঁরা যে আজ প্রাতঃকাল থেকে আমাকে এত ঘন ঘন খাতির করছেন এর কারণ কি? আচ্ছা মশায়, হরিবাবু-নামক কোনো একটি ভদ্রলোক আমাকে কেন এমন অসময়ে স্মরণ করলেন এবং হঠাৎ এতই অধৈর্য হয়ে উঠলেন বলতে পারেন কি?

কী! আমি আমার স্ত্রীর বালা গড়াবার জন্যে তাঁর কাছ থেকে নমুনাস্বরূপ গহনা এনে ফিরিয়ে দিচ্ছি নে? দেখো, এ সম্বন্ধে আমার অনেকগুলি কথা বলবার ছিল, কিন্তু আপাতত একটি বললেই যথেষ্ট হবে— আমি কারও কাছ থেকে কোনো গহনা আনি নি এবং আমার স্ত্রীই নেই। প্রধান প্রধান কথা আর যা বলবার ছিল সে আজকের মতো মাপ করবেন— গলা শুকিয়ে তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে মরছি। আপনি আর আধ ঘণ্টা কাল অপেক্ষা করুন, সমস্ত সমাচার অবগত হবেন। ( উচ্চৈঃস্বরে) ওরে উদয়, ওরে উদো, ওরে লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা পাজি ছুঁচো ড্যাম শুয়ার ইস্টুপিড— ওরে পেট যে জ্বলে গেল, গলা যে শুকিয়ে যায়, মাথা যে ফেটে যাচ্ছে— ওরে নরাধম, কুলাঙ্গার!

আরে না মশায়! আপনাদের সম্ভাষণ করছি নে। আপনারা হঠাৎ চঞ্চল হবেন না। আমি পেটের জ্বালায়, মনের খেদে, আমার প্রাণের বন্ধুকে ডাকছি। আপনারা বসুন।

আর বসতে পারছেন না? অনেক দেরি হয়ে গেছে? সে কথা আর আমাকে বলতে হবে না। দেরি হয়েছে সন্দেহ নেই। তা হলে আপনাদের আর পীড়াপীড়ি করে ধরে রাখতে চাই নে। তবে আজকের মতো আপনারা আসুন। আপনাদের সঙ্গে মিষ্টালাপে এতক্ষণ সময়টা বেশ সুখে কেটেছিল।

কিন্তু, এখন যে-কথাগুলো বলছেন ওগুলো কিছু অধিক পরিমাণেই বলছেন। খুব পরম বন্ধুকেও মানুষ ভালোবেসে শ্যালক সম্ভাষণ করতে হঠাৎ কুণ্ঠিত হয়, কিন্তু আপনাদের সঙ্গে অতি অল্পক্ষণের আলাপেই যে আপনারা এতটা বেশি ঘনিষ্ঠতা আত্মীয়তা করছেন সেজন্যে আমি মনে মনে কিছু লজ্জাবোধ করছি। জানবেন আপনাদের প্রতি আমার আন্তরিক কোনোরকম অসদ্ভাব নেই, কিন্তু আপনারা আমার কাছে যতটা প্রত্যাশা করছেন আমি ততটা দিতে একেবারে অক্ষম।

মশায়রা আর বাড়াবাড়ি করবেন না। আপনারা বোধ হয় দু বেলা নিয়মিত আহার করে থাকেন, খিদে পেলে মানুষের মেজাজটা কিরকম হয় ঠিক জানেন না, তাই আমাকে এমন অবস্থায় ঘাঁটাতে সাহস করছেন।

আবার! ফের! দেখো বাপু, আমার সঙ্গে পারবে না। শরীরটা দেখেই বুঝতে পারছ না! বহু কষ্টে রাগ চেপে আছি, পাছে একটা খুনোখুনি কাণ্ড করে বসি। আচ্ছা, আমাকে রাগাও দেখি। দেখি তোমাদের কত ক্ষমতা। কিছুতেই রাগাতে পারবে না। এই দেখো আমি খুব গম্ভীর হয়ে ঠাণ্ডা হয়ে বসলুম।

ও বাবা! এরা যে সবাই মিলে মারধোর করবার যোগাড় করে! খালি পেটে, খিদের উপর, মারটা সয় না দেখছি। আচ্ছা বাপু, তোমরা সবাই বোসো। তোমাদের কার কত পাওনা আছে বলো।— ভাগ্যি মাইনের টাকাটা পকেটে ছিল নইলে আজ নিতান্তই ধনঞ্জয়কে স্মরণ করে এক-পেট খিদেসুদ্ধ দৌড় মারতে হত। আপাতত প্রাণটা বাঁচাই, তার পর টাকাটা উদয়ের কাছ থেকে আদায়

করে নিলেই হবে। তোমার পাঁচ টাকা বৈ পাওয়া নয়, কিন্তু তুমি পঞ্চান্ন টাকার গাল পেড়ে নিয়েছ বাপু— এই নাও তোমার টাকা।

ওহে বাপু, তোমার হোটেলের বিল এই শুধে দিচ্ছি, যদি কখনো অসময়ে তোমাদের শরণাগত হতে হয় তা হলে স্মরণ রেখো।

তোমার তিন মাসের বাড়িভাড়া পাওনা? এক মাসের টাকাটা আজ দিচ্ছি, বাকি পরে নিয়ো। তুমি তো ভাই, তোমার গালমন্দ আমাকে ষোলো-আনাই চুকিয়ে দিয়েছ, তাতে বোধ করি তোমার মনটা কতকটা খোলসা হয়েছে, এখন আশীর্বাদ করে বাড়ি চলে যাও।

ওহে বাপু, তোমার গহনা ফিরিয়ে দেওয়া সহজ নয়। যদি আমার স্ত্রী থাকতেন আর তোমার গহনা তাঁকে দিতুম তা হলেও ফিরিয়ে আনা শক্ত হত; আর যখন তিনি বর্তমান নেই এবং তোমার গহনা তাঁকে দিই নি, তখন ফিরিয়ে আনা আরো কত কঠিন তা একটুখানি ভেবে দেখলে তুমিও হয়তো বুঝতে পারবে। তবু যদি পীড়াপীড়ি কর তা হলে কাজেই তোমার হরিবাবুর ওখানে আমাকে যেতে হবে, কিন্তু খাবারটা আসে কি না আর-একটু না দেখে যেতে পারছি নে।— উঃ! আর তো পারি নে। চন্দ্র, ওহে চন্দ্র! এখানে উদয়ের তো কোনো সম্পর্ক নেই, এখন তুমি সুদ্ধ অস্ত গেলে আমি যে অন্ধকার দেখি। চন্দ্র! ওহে চন্দ্রকান্ত! এই-যে এসেছ। চন্দ্র, তুমি তো তোমার বাবুকে চেন, সত্য করে বলো দেখি আজ কাল এবং পরশুর মধ্যে তিনি কি হোটেল থেকে ফিরবেন।

বোধ হয় ফিরবেন না? এতক্ষণ পরে তোমার এই কথাটি আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস হচ্ছে। যা হোক, বড্ড খিদে পেয়েছে, এখন আর গাল দেবার সময় নেই, এই আধুলিটি নিয়ে যদি চট করে কিছু খাবার কিনে আন তা হলে প্রাণ রক্ষে হয়।

লোকটা নবাবি করে বেড়ায় অথচ কাজকর্ম কিছু নেই, আমরা ভাবতুম চালায় কী করে! এখন ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। কিন্তু, প্রত্যহ এতগুলি গাল হজম ক'রে, এতগুলি বিল ঠেকিয়ে, এতগুলো লোক খেদিয়ে রাখা তো কম কাণ্ড নয়। এতে মজুরি পোষায় না, এর চেয়ে ঘানি ঠেলেও সুখ আছে।

কী হে! শুধু মুড়ি নিয়ে এলে? আর কিছু পাওয়া গেল না? পয়সা কিছু ফিরেছে? না? আচ্ছা, তবে দাও মুড়িই দাও।

আহার

ওহে চন্দ্র, কী বলব, ক্ষুধার চোটে এই বাসি মুড়ি যেন সুধা ব'লে বোধ হচ্ছে। অনেক নিমন্ত্রণ খেয়েছি, কিন্তু এমন সুখ পাই নি। চন্দ্র, তুমিই সুধাকর বটে, কিন্তু আজকে কলঙ্কের ভাগটাই কিছু বেশি দেখা গেল। ডাবও একটা এনেছ দেখছি, এর জন্যেও স্বতন্ত্র কিছু দিতে হবে নাকি?

হবে না? শরীরে দয়ামায়া কিছু আছে বোধ হচ্ছে, এখন যদি একটি গাড়ি ডেকে দাও তো আস্তে আস্তে বিদায় হই।

গাড়ি এখানে পাওয়া যায় না? তবে তো বড়ো বিপদে ফেললে। আমি এখন না খেয়ে কাহিল শরীরে দেড় ক্রোশ রাস্তা হাঁটতে পারব না; যখন সম্মুখে আহারের আশা ছিল তখন পেরেছিলুম।— কী করব! বেরিয়ে পড়া যাক।

কী সর্বনাশ! এই সময়ে আবার হরিবাবুর ওখানে যেতে হবে? চন্দ্র, তুমি আজ আমার বিস্তর উপকার করেছ, এখন আর কিছু করতে হবে না, এই ভদ্রলোকের ছেলেটিকে বুঝিয়ে দাও আমি উদয়বাবু নই, আমি আহিরীটোলার অক্ষয়বাবু।

ও তোমার কথা বিশ্বাস করবে না? সেজন্যে ওকে আমি বেশি দোষ দিতে পারি নে, বোধ হয় তোমাকে ও অনেক দিন থেকে চেনে। যা হোক, আর ঝগড়া করবার সামর্থ্য নেই, আস্তে আস্তে হরিবাবুর ওখানেই যাওয়া যাক। বাপু, যেরকম অবস্থা দেখছ পথে যদি একটা কিছু ঘটে দাহ করবার ব্যয়টা তোমার স্কন্ধে পড়বে—আগে থাকতে বলে রাখলুম।

চন্দ্র, তুমি আবার হাত বাড়াও কেন হে! তোমাদের কল্যাণে যেরকম সস্তায় আজ নেমন্তন্ন খেয়ে গেলুম বহুকাল আমার আর

খিদে থাকবে না। আরো কী চাও? ও! বকশিশ! সেটা চুকিয়ে দেওয়াই ভালো। যখন এতই করলেম তখন সর্বশেষে ঐ খুঁতটুকু আর রাখব না। কিন্তু আমার কাছে আর একটিমাত্র টাকা বাকি আছে। তার মধ্যে বারো-আনা আমি গাড়িভাড়ার জন্যে রেখে দিতে চাই। তোমার কাছে খুচরো, যদি কিছু থাকে তা হলে ভাঙিয়ে—

খুচরো নেই? ( পকেট উলটাইয়া শেষ টাকাটি দিয়া) তবে এই নাও বাপু। তোমাদের বাড়ি থেকে বেরোলুম একেবারে গজভুক্তকপিত্থবৎ।

কিন্তু এই-যে টাকাগুলি দিলুম, উদয়ের কাছ থেকে ফিরে আদায় করবার কী উপায় করা যায়! একটা দামি জিনিস যদি কিছু পাওয়া যায় তো আটক করে রাখি। দামি জিনিসের মধ্যে তো দেখছি ঐ চন্দ্রকান্ত; কিন্তু যেরকম দেখলুম ওঁকে সংগ্রহ করা আমার কর্ম নয়, আমাকে উনি ট্যাঁকে গুঁজে নিতে পারেন।

(কোণে একটা দেরাজ সবলে খুলিয়া) বাঃ, এই তো ঠিক হয়েছে। চেনটিও দিব্যি। তা হলে ঘড়িসুদ্ধ এইটি দখল করা যাক।

কী হে চন্দ্র, এত ব্যস্ত কেন?

পুলিস! পুলিস আসছে?

আমাকে পালাতে হবে? কেন, কী দুষ্কর্ম করেছি! কেবল এক ভদ্রলোকের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছি, তার যা শাস্তি যথেষ্ট হয়েছে।

তাই তো সত্যিই দেখছি! চন্দ্র কোথায় গেল! হরিবাবুর সেই লোকটিকেও যে দেখছি নে! সবাই পালিয়েছে!

দেখো বাপু, গায়ে হাত দিয়ো না। ভালো হবে না। আমি ভদ্রলোক। চোর নই, জালিয়াত নই।

উঃ, কর কী! লাগে যে! বাবা, আজ সমস্ত দিন কেবল মুড়ি খেয়ে পথ চেয়ে আছি, আজ তোমাদের এ-সব ঠাট্টা আমার ভালো লাগছে না।

পেয়াদা-বাবা, বরঞ্চ কিছু জলপানি নাও। ( পকেটে হাত দিয়া) হায় হায়, একটি পয়সা নেই। দারোগা-সাহেব, যদি চোর ধরতে চাও, চলো আমি তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি। জেল সৃষ্টি হয়ে পর্যন্ত এতবড়ো চোর পৃথিবীতে দেখা দেয় নি।

কী করেছি বলো দেখি। জীবনবাবুর নাম সই করে হ্যামিল‍্‍টনের দোকান থেকে ঘড়ি এনেছি? পেয়াদা-সাহেব, ভদ্রলোক হয়ে ভদ্রলোকের নামে ফস করে এতবড়ো অপবাদটা দিলে?

ও কী ও! ওটা ধরে টেনো না। ও আমার ঘড়ি নয়। শেষকালে যদি চেন-মেন ছিঁড়ে যায় তা হলে আবার মুশকিলে পড়তে হবে।

কী? এই সেই হ্যামিল‍্‍টনের ঘড়ি? ও বাবা, সত্যি নাকি! তা, নিয়ে যাও, নিয়ে যাও, এখনি নিয়ে যাও। কিন্তু, ঘড়ির সঙ্গে আমাকে সুদ্ধ টান কেন? আমি তো সোনার চেন নই। আমি সোনার অক্ষয় বটে, কিন্তু সেও কেবল বাপ-মায়ের কাছে।

তা, নিতান্তই যদি না ছাড়তে পার তো চলো। বাবা, আমাকে সবাই ভালোবাসে, আজ তার বিস্তর পরিচয় পেয়েছি, এখন তোমার ম্যাজিস্ট্রেটের ভালোবাসা কোনোমতে এড়াতে পারলে এ যাত্রা রক্ষে পাই। –

যদি জোটে রোজ

এমনি বিনি পয়সায় ভোজ।

 
Contact/Feeback